সেবার নামে ক সা ই গিরী
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের জন্য পঁচা খাবার, ফরমালিনযুক্ত কলা!


Oplus_131072
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের জন্য পঁচা খাবার, ফরমালিনযুক্ত কলা!
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি:
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দেশের অন্যতম বৃহৎ সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র। কিন্তু এখানে চিকিৎসা নিতে এসে রোগীরা শুধু চিকিৎসার অনিয়মই নয়, নিম্নমানের খাবার ও দুর্নীতির চক্রের শিকার হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালে রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার অস্বাস্থ্যকর, পঁচা ও নিম্নমানের। অসুস্থ মুরগি, ফরমালিনযুক্ত কলা, আর শুধুমাত্র পাংগাস মাছ পরিবেশন করা হয়। এতে একদিকে রোগীরা অসুস্থতার ঝুঁকিতে পড়ছেন, অন্যদিকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে বিশাল দুর্নীতির চক্র।
পঁচা খাবার ও ফরমালিনযুক্ত ফল: রোগীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে
হাসপাতালের রোগীদের জন্য সরবরাহ করা খাবার মানহীন ও অস্বাস্থ্যকর। অভিযোগ রয়েছে, বরাদ্দ অনুযায়ী খাবার সরবরাহ না করে কম দেওয়া হয় এবং নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।
এক রোগীর স্বজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “রোগীদের জন্য যে খাবার দেওয়া হয়, তা খাওয়ার উপযুক্ত নয়। তরকারিতে দুর্গন্ধ, মাছ প্রায়শই বাসি, আর মুরগির মাংসের মধ্যে অনেক সময় পঁচা গন্ধ পাওয়া যায়। অনেক রোগী এসব খাবার খেয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।”
এছাড়া, রোগীদের দেওয়া কলা ফরমালিন দিয়ে পাকানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। একাধিক রোগীর পরিবার জানায়, “হাসপাতালের কলাগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চকচকে, কাটলেই বোঝা যায় এগুলো কৃত্রিমভাবে পাকানো।”
এক রোগীর স্বজন জানান, “হাসপাতালে দেশি মাছের পরিবর্তে শুধুমাত্র পাংগাস মাছ দেওয়া হয়, যা অনেক সময় বাসি থাকে।”
জরুরি বিভাগেও দুর্নীতি: টাকা ছাড়া সেবা মেলে না
জরুরি বিভাগে রোগী নিয়ে আসা মাত্রই নিতে হয় ১০ টাকার টিকিট। তবে ভর্তি করাতে হলে ২০ টাকা দিতে হয়, যদিও টিকিটের গায়ে লেখা থাকে ১৫ টাকা। এরপর রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য হুইলচেয়ার ব্যবহার করলে দিতে হয় ১০০ টাকা, আর ট্রলিতে নিলে ২০০ টাকা।
একজন রোগীর স্বজন জানান, “আমার বাবাকে নিয়ে আসলাম, অবস্থা খুব খারাপ ছিল। কিন্তু ট্রলিতে না নিলে তারা নিতেই রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে ২০০ টাকা দিলাম।”
বেড পেতে ঘুষ, নইলে মেঝেতে থাকতে হবে
হাসপাতালে আসা অনেক রোগী জানান, বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার কথা থাকলেও এখানে বেড পেতে ৫০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। টাকা না দিলে রোগীদের মেঝেতে থাকতে হয়।
এক রোগীর স্বজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “টাকা দিলেই বেড পাওয়া যায়, না হলে মাটিতে থাকতে হয়। অথচ এটা সরকারি হাসপাতাল, সবার জন্য সমান সুযোগ থাকার কথা।”
পরীক্ষা ও ওষুধের নামে অতিরিক্ত ব্যয়
রোগী ভর্তির পর চিকিৎসকের পরামর্শ মানেই অন্তত ৪-৫টি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এসব পরীক্ষার বেশির ভাগই হাসপাতালের বাহিরে নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করানোর জন্য বলা হয়।
এক রোগীর ছেলে বলেন, “ডাক্তার প্রথম দিনই অনেকগুলো পরীক্ষা দিলো। এক পরীক্ষার রিপোর্ট আসার আগেই আরেক ডাক্তার এসে নতুন পরীক্ষা দিলো। এভাবে প্রতিদিনই নতুন পরীক্ষা আর নতুন ওষুধের লিস্ট ধরিয়ে দেয়।”
অপারেশন থিয়েটারে দুর্নীতি: ওষুধ কিনতে বাধ্য করা হয়
যেসব রোগীর অপারেশন প্রয়োজন, তাদের ৬০০০ থেকে ৭০০০ টাকার ওষুধ কিনে সরাসরি ডাক্তারের হাতে দিতে হয়, যা ফেরতযোগ্য নয়।
এক রোগীর আত্মীয় ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগেই ৭০০০ টাকার ওষুধ কিনে দিলাম। কিন্তু ডাক্তার বললেন, এটা ফেরতযোগ্য না, লাগবে না হলেও ফেরত নেওয়া যাবে না।”
রোগী সুস্থ হলেও টাকা ছাড়া রিলিজ মেলে না
রোগী সুস্থ হয়ে রিলিজ পাওয়ার সময় ওয়ার্ড বয়, নার্স এবং দারোয়ানদের খুশি করতে আলাদাভাবে টাকা দিতে হয়।
এক রোগীর পরিবার জানায়, “রিলিজ পেপার দিতে বিলম্ব করতে থাকে। পরে ওয়ার্ড বয়কে ২০০ টাকা দেওয়ার পর সব ব্যবস্থা হয়ে গেলো।”
চিকিৎসার নামে চলছে দুর্নীতির বাণিজ্য!
এভাবে পুরো হাসপাতাল ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। রোগীরা চিকিৎসা সেবা না পেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অথচ হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে লেখা থাকে— “আমি ও আমরা সবাই সাধু!”
কর্তৃপক্ষ কী বলছে?
হাসপাতালের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, “আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি। কিছু অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে অনিয়মের শিকার রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, এই দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। তারা এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানান।
সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান
সরকারি হাসপাতাল সাধারণ মানুষের শেষ ভরসা। তাই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে দরিদ্র ও অসহায় রোগীরা সঠিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে।