সন্তানের হাতে বাবা-মায়ের নির্মম মৃত্যু: প্রযুক্তির অন্ধ নেশায় এক পরিবার ধ্বংসের গল্প

সন্তানের হাতে বাবা-মায়ের নির্মম মৃত্যু: প্রযুক্তির অন্ধ নেশায় এক পরিবার ধ্বংসের গল্প
নজরুল ইসলাম কাজল
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার এক বাড়িতে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনা যেন ছুরির মতো বিদ্ধ করে দিয়েছে গোটা জাতির বিবেককে। এক সময় যেই ঘরে ভালোবাসা, নির্ভরতা আর আশ্রয়ের গল্প লেখা হতো, আজ সেই ঘরই হয়ে উঠেছে নৃশংসতার এক ভয়াবহ প্রেক্ষাগৃহ। জন্মদাতা বাবা-মা খুন হয়েছেন তাদেরই সন্তানের হাতে—এই সংবাদ শুধু একটি পরিবারের দুর্ভাগ্য নয়, বরং গোটা সমাজের এক করুণ ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
ভালোবাসার ঘর থেকে হত্যার মঞ্চে
যে হাত একদিন সন্তানের হাত ধরেছিল হাঁটতে শেখানোর জন্য, যে কণ্ঠে প্রথম “বাবা” “মা” ডাক শুনে আনন্দে চোখে জল এসেছিল—সেই হাতই একদিন হয়ে উঠলো হত্যার হাতিয়ার। সেই কণ্ঠই উচ্চারণ করলো হিংস্রতার নিঃশব্দ মন্ত্র। আর এই পরিণতির শুরু হয়েছিল একটি সহজ প্রশ্ন দিয়ে—”টাকা দাও”।
এটা শুধু টাকা নয়, এটা ছিল এক নেশা—অনলাইন জুয়া ও বেটিং-এর ভয়াবহ আসক্তি। যে আসক্তি আজ তরুণদের এক শ্রেণিকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকার গহ্বরে, যেখানে মানবতা, নৈতিকতা কিংবা সম্পর্কের আর কোনো মূল্য থাকে না।
প্রযুক্তির আলোয় অন্ধকারের বিস্তার
আমরা এমন এক যুগে বসবাস করছি যেখানে প্রযুক্তির বিস্তার প্রশংসনীয় হলেও, এর অপব্যবহার হয়ে উঠছে ভয়ংকর। অনলাইন গেম, বেটিং অ্যাপস, লাইভ ক্যাসিনো কিংবা ভুয়া ইনকামের প্রতিশ্রুতিমূলক অ্যাপ্লিকেশন—সবকিছু যেন তরুণদের আসক্তির ফাঁদে ফেলছে। আর পরিবারের অসচেতনতা, সমাজের নির্লিপ্ততা এবং রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা—সব মিলিয়ে এক বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
এই ছেলেটির ঘটনাও এর বাইরে কিছু নয়। টাকা না পেয়ে, বাবা-মাকে হত্যা করে সে নিজ হাতে লাশ গুম করেছে ঘরের মাটিতে। কল্পনাকেও হার মানায় এমন নিষ্ঠুরতা। প্রশ্ন উঠেছে—“সন্তান জন্ম দিয়ে কি ভুল করেছিল বাবা-মা?”
এই দায় কার?
এই একক কোনো ব্যক্তির নয়—বরং একটি সম্মিলিত সামাজিক ব্যর্থতার দলিল।
১. পরিবার, যারা সন্তানের প্রযুক্তি ব্যবহারে নজরদারি করতে পারেনি।
২. সমাজ, যারা অবৈধ অ্যাপ, জুয়ার বিজ্ঞাপন, অশালীন লাইভের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি।
৩. রাষ্ট্র, যারা এখনও কার্যকরভাবে এইসব অ্যাপ নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিগত এবং আইনি পদক্ষেপ নেয়নি।
আমরা কি কখনো জিজ্ঞাসা করি, আমাদের সন্তানরা সারাদিন অনলাইনে কী করছে? আমরা কি শুধু পরীক্ষার ফল নিয়েই সন্তুষ্ট? না কি মানসিক স্বাস্থ্য, নৈতিকতা ও আচরণবিধি নিয়েও তাদের সঙ্গে কথা বলি?
সমাধানের পথ: কথা বলা এখনই দরকার
এই ঘটনার মতো পরিণতি এড়াতে আমাদের করণীয়:
১. পারিবারিক যোগাযোগ জোরদার করুন: সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করুন। খোলামেলা কথা বলুন।
২. নৈতিক ও প্রযুক্তি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করুন: স্কুল-কলেজে ‘ডিজিটাল নৈতিকতা’ বিষয় অন্তর্ভুক্ত হোক।
৩. অনলাইন জুয়া ও বেটিং অ্যাপ নিষিদ্ধ হোক: কঠোর আইন, নজরদারি এবং সাইবার মনিটরিং অপরিহার্য।
সামাজিক সচেতনতা গড়ুন: ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ শুরু হোক।
শেষ কথা: যেন এই মৃত্যু বৃথা না যায়
একটি পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। কিন্তু এই মৃত্যুগুলো যেন কেবল “একটি দুঃসংবাদ” হিসেবে না থেকে যায়। এটি হোক আমাদের সমাজের আত্মসমালোচনার মুহূর্ত। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—একজন ভালো মানুষ তৈরি করতে সময় লাগে, কিন্তু একজন অমানুষ তৈরি হতে পারে এক রাতেই।
যে সন্তান একদিন বাবার আঙুল ধরে হেঁটেছিল, তার হাতে যেন আর কখনো ঝরে না পড়ে বাবা-মায়ের রক্ত। এখনই সময় জেগে ওঠার, প্রশ্ন করার, আর ভবিষ্যতের পথে একটি মানবিক সমাজ গড়ে তোলার।
নজরুল ইসলাম কাজল
যুগ্ন আহবায়ক
বাংলাদেশ আন্ত: বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী কর্মচারী ফেডারেশন।
