জাতীয় পে-স্কেল ও কর্মচারীর মর্যাদা: এখনই সময় নতুন করে ভাবার

জাতীয় পে-স্কেল ও কর্মচারীর মর্যাদা: এখনই সময় নতুন করে ভাবার
নজরুল ইসলাম (কাজল)
যুগ্ম আহবায়ক
বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী কর্মচারী ফেডারেশন
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করে বাংলাদেশ আজ একটি নতুন পথচলার দিশায় এগিয়ে যাচ্ছে—উন্নয়নশীল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর স্বপ্নে বিভোর জাতি। এই অভিযাত্রায় প্রশাসনের প্রতিটি স্তরের কর্মচারীই নিঃসন্দেহে এক অনন্য শক্তি। তাদের নীরব শ্রম, নিষ্ঠা ও দক্ষতা আজকের এই অগ্রগতির মূলে রয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কর্মচারীরা দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন প্রশাসনিক সহায়তা দিয়ে চলেছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে, দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী এখনো তাদের ন্যায্য আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত।
২০১৫ সালের পে-স্কেল: বাস্তবতা ও ব্যর্থতা
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালে ঘোষিত ৮ম জাতীয় পে-স্কেল অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু এর পর থেকে এক দশকের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয়, বাসস্থান খরচ—সব কিছুই একাধিক গুণে বেড়ে গেছে। ফলে কার্যত এই বেতন কাঠামো আজ বাস্তব জীবনযাত্রার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সমস্যাটি আরও জটিল। একদিকে ৮ম পে-স্কেল অনেক ক্ষেত্রে আংশিকভাবে বাস্তবায়িত, অন্যদিকে টাইম স্কেল, ইনক্রিমেন্ট, উৎসব ভাতা, পেনশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও বৈষম্য লেগেই আছে। এসব কারণে কর্মচারীরা যেমন আর্থিক চাপে থাকেন, তেমনি পেশাগত অসন্তোষও বাড়তে থাকে।
যোগ্যতা ও দায়িত্বের স্বীকৃতি কোথায়?
একজন কর্মচারীর কাজ শুধুই মেকানিকাল নয়—তিনি প্রশাসনিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করেন, সেবা কার্যক্রমে অংশ নেন, নীতিনির্ধারণী বাস্তবায়নে সহায়তা করেন এবং জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে অবদান রাখেন। অথচ বাস্তব চিত্র হলো, তাদের কাজের প্রকৃতি, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং দায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতে যথোপযুক্ত আর্থিক ও পেশাগত স্বীকৃতি প্রদান করা হয় না। এটি সামাজিক বৈষম্য ও অনাস্থার একটি বড় উৎসে পরিণত হচ্ছে।
সমাধানের পথ: একটি সময়োপযোগী প্রস্তাবনা
বর্তমান বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনায় আমরা এখন আর পুরনো কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারি না। নতুন বাস্তবতায় উদার, ন্যায্য এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় পে-স্কেল পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। এ প্রেক্ষিতে কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি:
১. নবম জাতীয় পে-স্কেল প্রণয়ন: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার মান অনুযায়ী একটি নতুন পে-স্কেল অবিলম্বে ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. বেতন বৈষম্য হ্রাস: সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত যৌক্তিক ও মানবিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা পায়।
৩. ইনফ্লেশন অ্যাডজাস্টমেন্ট চালু: প্রতি বছর মূল্যস্ফীতির হার অনুসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেতন সমন্বয়ের (COLA) ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
৪. বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের জন্য বিশেষ স্কেল: বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের কাজের প্রকৃতি ভিন্ন হওয়ায় তাদের জন্য পৃথক ও যুক্তিসঙ্গত স্কেল প্রণয়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।
৫. পেশাগত প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতির সুযোগ: দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও স্বচ্ছভাবে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কর্মচারীরা পেশাগতভাবে আরও বিকশিত হতে পারেন।
মর্যাদা ছাড়া প্রেরণা আসে না
জাতীয় পে-স্কেল শুধু বেতনের কাঠামো নয়—এটি একজন কর্মচারীর সম্মান, স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ববোধের প্রতিচ্ছবি। যদি একজন কর্মচারী ন্যায্য সম্মান না পান, তাহলে তার পেশাগত প্রেরণাও ক্ষুণ্ন হয়। এটি দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোকে দুর্বল করে দিতে পারে।
আমরা যারা দেশের অগ্রগতিতে নিয়োজিত, তাদের সবার প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই একটি মানবিক রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে উঠবে। তাই সময় এসেছে কর্মচারীদের চাহিদা, শ্রম ও অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন করার। একটি নতুন পে-স্কেলের মাধ্যমে এ উদ্যোগ শুরু হোক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
