ময়মনসিংহের টিটিসির অন্দরমহল: দক্ষতার স্বপ্ন থেকে দুর্নীতির দুঃস্বপ্ন
Oplus_16908288

ময়মনসিংহের টিটিসির অন্দরমহল: দক্ষতার স্বপ্ন থেকে দুর্নীতির দুঃস্বপ্ন
ময়মনসিংহ শহরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি)—নাম শুনলেই সাধারণ মানুষের মনে ভেসে ওঠে বিদেশযাত্রার স্বপ্ন, জীবিকা বদলের আশা, আর পরিবারের ভাগ্য ফেরানোর আকাঙ্ক্ষা। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য ছিল তরুণদের দক্ষ করে বিদেশে পাঠানো। কিন্তু আজ সেই প্রতিষ্ঠানের ভেতর প্রবেশ করলে অন্য এক বাস্তবতা চোখে পড়ে—যেখানে স্বপ্ন নয়, বেচাকেনা হচ্ছে মানুষের ভবিষ্যৎ।
ভর্তি পরীক্ষার দিন সকালে, গেটে ভিড় জমায় শত শত ছেলে-মেয়ে। হাতে কাগজপত্র, চোখে উজ্জ্বল স্বপ্ন। কিন্তু তারা খুব দ্রুত বুঝে যায়—এই দৌড়ে টিকতে হলে শুধু যোগ্যতা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মোটা অঙ্কের টাকা। ভেতরে বসে থাকা দালালরা ফিসফিস করে বলে ওঠে—“ভাই, সিট নিতে চাইলে ৫০ হাজার দিতে হবে, না হলে জায়গা নেই।”
সিটের দ্বিগুণ ভর্তি
হাউজকিপিং কোর্সে আসন সংখ্যা যেখানে ৩০, সেখানে দেখা যায় ভর্তি হয়েছে ৬০ জন। তাকামুল প্রশিক্ষণেও একই অবস্থা। অভিযোগ অনুযায়ী, নির্ধারিত ফি’র বাইরে হাতবদল হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। আর সেই টাকা ভাগাভাগি হচ্ছে দালাল, অফিস স্টাফ থেকে শুরু করে কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, “টাকার বিনিময় ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানে একটা চেয়ারের জায়গাও পাওয়া যায় না।”
অন্ধকারের আড়ালে চক্র
সবকিছুর পেছনে নাম আসে প্রিন্সিপাল মাহতাব উদ্দিনের। বলা হয়, তার প্রত্যক্ষ আশ্রয়েই দালালচক্র শক্তপোক্ত হয়েছে। তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন প্রশিক্ষক শাহিদা আক্তার ও নাজমুন নাহার মুন্নি, স্টোর কিপার গোলাম মোস্তফা, এমনকি দারোয়ান পর্যন্ত। টিটিসি এখন আর কারিগরি শিক্ষা নয়, বরং রূপ নিয়েছে অঘোষিত বাণিজ্যিক হাটে।
দোকানের ভাড়া, মাসোহারা, গোপন আয়
প্রশিক্ষণ ভবনের বাইরের দেয়াল ঘেঁষে একের পর এক দোকান। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব দোকান প্রিন্সিপালের অনুমতিতে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। মাসে মাসে ভাড়া ওঠে, কিন্তু সেই টাকা সরকারি খাতায় জমা হয় না—উড়ে যায় চক্রের পকেটে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই এমন প্রকাশ্য বাণিজ্য চলতে দেখে সাধারণ মানুষ হতবাক।
অভিযোগ অস্বীকার, তবু প্রশ্ন থেকে যায়
প্রিন্সিপাল মাহতাব উদ্দিন অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, “এমন কোনো দুর্নীতি নেই।” কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথা বলে। এক শিক্ষার্থী হাহাকার করে বলে ওঠে, “টাকা না দিলে এখানে কিছু হয় না। স্বপ্ন দেখাই শুধু, কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়—সবই বিক্রি হয়ে গেছে।”
এই ঘটনা স্থানীয়ভাবে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। সচেতন মহল মনে করছে, সরকারি এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে দালালি ও দুর্নীতি শুধু শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করছে না, বরং সরকারের ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তারা বলছেন, “টিটিসি যদি এভাবে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়, তবে দক্ষ জনশক্তি গঠনের স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যাবে।”
গল্পটা এখানেই শেষ নয়। বরং প্রশ্ন জাগে—যে প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে একসময় বড় অক্ষরে লেখা ছিল “দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিই আমাদের লক্ষ্য”, সেখানে এখন অদৃশ্য কালি দিয়ে লেখা আছে “ঘুষ ছাড়া কিছু মেলে না।”
জনগণ জানতে চায়, সরকারের টনক নড়বে কবে? ভুক্তভোগীদের স্বপ্ন ফেরত দেবে কে? আর এই টিটিসি—যেখানে শিক্ষার আলোর কথা বলা হয়েছিল—তা কি আবারও সত্যিকারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রূপ নেবে, নাকি দুর্নীতির অন্ধকারেই ডুবে যাবে? (
চলবে)
