ময়মনসিংহে সেতু নয়, দুর্নীতির সুনামি—ব্রহ্মপুত্রের বুকে উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রীয় অপচয়ের মহাকাব্য

ময়মনসিংহে সেতু নয়, দুর্নীতির সুনামি—ব্রহ্মপুত্রের বুকে উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রীয় অপচয়ের মহাকাব্য
কাগজের আলো
প্রতিবেদন: মোঃ বিল্লাল হোসেন মানিক
ময়মনসিংহ শহরের বুকে ব্রহ্মপুত্র নদে নির্মাণাধীন কেওয়াটখালি ও রহমতপুর সেতু দুটির প্রকল্প যেন এখন উন্নয়নের প্রতীক নয়, বরং দুর্নীতি, অনিয়ম ও জনগণের প্রতি অবহেলার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। বিশাল অঙ্কের রাষ্ট্রীয় অর্থ, জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, নকশা জালিয়াতি, সময়ক্ষেপণ, স্বচ্ছতার অভাব ও মানহীন কাজ—সব মিলিয়ে এই প্রকল্প দুটির চিত্র ভয়াবহ।
কেওয়াটখালি ব্রিজের কথা প্রথম আসে ২০২১ সালের আগস্টে। চার বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের মাত্র ৫ শতাংশ কাজ হয়েছে বলে অভিযোগ। প্রকল্পের সময়সীমা শেষ হতে বাকি মাত্র কয়েকদিন—৩০ জুন ২০২৫। অথচ কাজের গতি দেখে মনে হয়, এটি একটি ‘ঠেকায় পড়ে থেমে থাকা’ প্রকল্প। প্রকল্প পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ নকশা জালিয়াতি ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে নকশা পরিবর্তন। এতে নতুন করে ৩২ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব আসে, যার মধ্যে স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, দোকানপাট, শিল্প-কারখানার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও রয়েছে।
অন্যদিকে রহমতপুর ব্রিজ, যার নকশা অনুযায়ী দৈর্ঘ্য ও কাঠামো কেওয়াটখালির চেয়েও বড়, সেখানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে মাত্র ৩০ একর। অথচ কেওয়াটখালির জন্য ৮১ একরের পর আরও ৩২ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব তোলা হয়েছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে—এটা কি প্রকল্প না-কি প্রজেক্টের আড়ালে প্রভাবশালীদের সম্পদ লুটের উৎস?
ব্যয় বিচারে পার্থক্য আরও বিস্ময়কর। রহমতপুর ব্রিজের জন্য বরাদ্দ ১,৮৪২ কোটি টাকা, আর কেওয়াটখালির জন্য ধরা হয়েছে ৩,২৬৩ কোটি টাকা। যদিও লেন সংখ্যা ভিন্ন (কেওয়াটখালিতে ৪ লেন, রহমতপুরে ২), কিন্তু অতিরিক্ত ১,৪২১ কোটি টাকার খরচ কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি অনুমান করা হচ্ছে কেওয়াটখালির কাজ শেষ করতে আরও ২,০০০ থেকে ৫,০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত লাগতে পারে।
উভয় সেতুর জন্য নির্ধারিত ১২০ কোটি টাকার পরামর্শক খরচও তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। দেশে বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের মতো দক্ষ প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও বিদেশি বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই ডিজাইন করানো যেন জনগণের করের টাকার মেঝেতে ছিটিয়ে ফেলার নামান্তর।
সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো—প্রকল্পে জনগণের কোনও অংশগ্রহণ নেই। স্থানীয়দের সাথে মতবিনিময়, গণশুনানি, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন কিছুই হয়নি। কেওয়াটখালির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে রেল সংযোগ রাখা হয়নি, যা ভবিষ্যতের পরিবহন ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করবে। শম্ভুগঞ্জে সরাসরি সংযোগের ফলে শহরের যানজট পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ময়মনসিংহ ইতোমধ্যেই বিশ্বের অন্যতম ধীরগতির শহর হিসেবে চিহ্নিত; এই সেতু নির্মাণের পর তা আরও চরম রূপ নিতে পারে।
এছাড়া নির্মাণকাজের গুণগত মান নিয়েও আছে গুরুতর উদ্বেগ। কোনও কার্যকর নিরপেক্ষ তদারকি ব্যবস্থা না থাকায় নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে, যা জননিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির খবর না তুলে, তারা বরং দুর্নীতিবাজদের পক্ষ নেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। সাংবাদিকতার এই বিপর্যয় প্রকৃত সত্য চাপা দিতে সহায়ক হচ্ছে।
এই পুরো চিত্র এখন আর উন্নয়নের নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, জবাবদিহির অভাব এবং শাসনব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। যে সেতু জনগণের জন্য নির্মিত হওয়ার কথা, তা এখন জনগণের বিরুদ্ধে নির্মিত এক যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এখন প্রয়োজন স্বাধীন তদন্ত, প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও গণসম্পৃক্ততা নিশ্চিতকরণ, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ। নচেৎ এই সেতু দুটি ভবিষ্যতের ইতিহাসে ‘অপচয় ও অবিচারের ব্রিজ’ হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
