আকুয়া ওয়ারলেছের সরকারি জমি নিজের সম্পত্তি বানালেন বিটিসিএল কর্মকর্তা রকিবুল

আকুয়া ওয়ারলেছের সরকারি জমি নিজের সম্পত্তি বানালেন বিটিসিএল কর্মকর্তা রকিবুল — অবৈধ বিদ্যুৎ, সরকারি গাড়ি আর গাছবেচা টাকা দিয়ে গড়েছেন কোটি টাকার সাম্রাজ্য
ময়মনসিংহ নগরীর আকুয়া এলাকায় বিটিসিএলের ট্রান্সমিশন কার্যালয়ের পাশে দাঁড়ালে প্রথমেই চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। চারদিকে সবুজ আর সোনালি শীষের দোল। দূরে দু’জন শ্রমিক ধান কাটছে, যেন কোনো কৃষকের মাঠে নেমেছে ফসল তোলার উৎসব। কিন্তু এই ক্ষেত কোনো কৃষকের নয়—এটি সরকারের জমি। আর এই জমিতেই ধান, সরিষা, সবজি, কলা, এমনকি মাছ চাষ করছেন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি (বিটিসিএল) ময়মনসিংহ ট্রান্সমিশন কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. রকিবুল ইসলাম।
কথায় বলে, “সরকারি মাল মানেই সবার মাল”—কিন্তু রকিবুল ইসলামের কাছে মনে হয় তার উল্টো। এই সরকারি জমিগুলো যেন তার নিজস্ব পৈতৃক সম্পত্তি। কার্যালয়ের ভেতরে প্রায় ৬ একর জায়গা তিনি দখলে নিয়ে করেছেন চাষাবাদ। ধান, সবজি, কলা, সরিষা—সবই আছে সেখানে। এমনকি দুটি বড় পুকুরে মাছও চাষ হচ্ছে, যা চলছে অবৈধ বিদ্যুৎসংযোগে। স্থানীয়রা বলেন, অফিসের বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে তার টেনে এসব পাম্পে দেওয়া হয়। সরকারকে একটাকাও না দিয়ে নিজের ফসল সেচ দিচ্ছেন তিনি, আর উৎপাদিত ধান-সবজি-মাছ বিক্রি করে বাড়াচ্ছেন নিজের আয়।
এই চাষাবাদের গল্পে শুধু বিদ্যুতের অপব্যবহারই নেই, আছে আরও অনেক কিছুর মিশেল। অফিসের গাছ কেটে বিক্রি, পরিত্যক্ত ভবনের দরজা-জানালা খুলে বিক্রি, এমনকি পুরোনো লোহা আর ইট খুলে বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা বলেন, অফিসে এখন সরকারি কাজের চেয়ে ফসল তোলার কাজই বেশি হয়। কার্যালয়ের গেট সবসময় বন্ধ থাকে, বাইরের কেউ ঢুকতে পারে না। অফিসের দারোয়ান, কর্মচারী—সবাই যেন স্যারের “কৃষি টিমের” সদস্য।
স্থানীয় শাহিনুল ইসলাম বলেন, “আগে গেট খোলা থাকত, এখন তালা দেওয়া। রকিবুল স্যার নিজে ধান, সবজি, মাছ বাড়িতে পাঠান। সরকারি গাড়িতে নিজের মেয়েকে স্কুলে- কোচিংয়ে নিয়ে যান, আবার গ্রামের বাড়ি জামালপুরও যান নিয়মিত। এসব তেলের বিল কার পকেট থেকে যায়, তা আমরা জানি।”
আরও বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই অনিয়মের মূল সহযোগী একজন সুইপার—হেলাল। অফিসে তাকে সবাই “স্যারের হাতিয়ার” বলে ডাকে। হেলালই নাকি ধান্দা খোঁজে, কোথায় কী বেচা যায়, কোন গাছ কাটা যাবে—সব তার নিয়ন্ত্রণে। অফিসের ভেতরে কে কী করছে, তা স্যারের আগে সে জানে। স্থানীয়রা বলেন, “এই হেলাল সারাদিন দৌড়ায়। পুরোনো বিল্ডিংয়ের ইট খুলে বিক্রি করে, বেকু লাগিয়ে মাটি বিক্রি করে, গাছ কেটে বিক্রি করে। মনে হয় বিটিসিএলের ওই জায়গা তার বাপ-দাদার।”
সরেজমিনে দেখা যায়, ধান কেটে নিচ্ছে শ্রমিক ইদ্রিস আলী। জিজ্ঞেস করলে বলেন, “স্যারের কাছ থেকে কাঠাপ্রতি ছয়শ টাকা চুক্তি করেছি। ফলন ভালো হয়েছে, কাঠাপ্রতি সাড়ে তিন থেকে চার মণ ধান হবে। পরে ধান কে নেবে আমরা জানি না, স্যার বলেননি।”
অন্যদিকে কার্যালয়ের টেকনিশিয়ান শাহজাহান হোসেন বলেন, “স্যারের পরামর্শে আমরা কয়েকজন মিলে চাষাবাদ করেছি, নিজের টাকায়। সমান ভাগে ভাগ করি। কোনো অন্যায় করিনি।”
অভিযোগ অস্বীকার করে প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম বলেন, “এখানে সবাই পরিবারের মতো। অনাবাদি জমি পড়ে ছিল, তাই চাষ করেছি। সরকারি গাড়ি মাঝেমধ্যে পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যবহার হয়, এটা অপরাধ নয়। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানেন।”
কিন্তু স্থানীয়দের মতে, রকিবুল ইসলাম জামালপুরের বাসিন্দা এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজমের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। সেই প্রভাবেই তিনি প্রায় আট বছর ধরে একই জায়গায় চাকরি করছেন। এই সময়েই গড়ে তুলেছেন নিজের “গোপন রাজ্য”।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, “একজন সরকারি কর্মকর্তা রাষ্ট্রের সম্পদকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে পারেন না। তিনি নিয়ম ভেঙে নিজের লাভ করছেন—এটা স্পষ্ট দুর্নীতি। আমরা তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত ও অপসারণ দাবি করছি।”
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ইন্দ্রজিৎ দেবনাথ বলেন, “বিটিসিএল আমাদের গ্রাহক প্রতিষ্ঠান। যদি তারা অবৈধ সংযোগে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ময়মনসিংহের আকুয়া ট্রান্সমিশন কার্যালয়ের এই চিত্র যেন সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের এক ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি। সরকারি জমি, বিদ্যুৎ, গাড়ি, এমনকি গাছ—সব কিছুই এক কর্মকর্তার হাতে গিয়ে যেন ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, “সরকারের জায়গা সবার, কিন্তু এখন মনে হয় সবই রকিবুল স্যারের। যেন সরকারি চাকরি নয়, নিজের রাজ্য চালান তিনি।”
একজন কর্মচারী কণ্ঠ নামিয়ে বললেন—
“এখানে এখন সবাই ভয় পায় কথা বলতে। মনে হয় অফিসটা সরকারি না, রকিবুল স্যারের বাবার সম্পত্তি।”
