ভোক্তা অধিকারের উদাসীনতায় প্রতিহিংসার শিকার মাংস ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম!


ময়মনসিংহে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ১২০ কেজি মাংস ধ্বংস, ১০ হাজার টাকা জরিমানা: প্রতিহিংসার অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম
মোঃ বিল্লাল হোসেন মানিক ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ বাজারে “রহিমের গোস্তের দোকানে” কুকুরে কামড়ানো গরুর মাংস বিক্রির অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ১২০ কেজি মাংস ধ্বংস ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে এই অভিযানে কোনো ল্যাব টেস্ট, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বা ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়াই শাস্তি প্রদান করায় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিহিংসার অভিযোগ উঠেছে।
অভিযানের বিবরণ
গত মঙ্গলবার (৪ মার্চ) দুপুরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কোতোয়ালী মডেল থানা পুলিশের যৌথ অভিযানে শম্ভুগঞ্জ বাজারের “রহিমের গোস্তের দোকানে” এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়। অভিযানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক মেম্বার কামাল ও বাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীর দাবি: প্রতিহিংসার শিকার হলেন তিনি
দোকানের মালিক মো. আব্দুর রহিম জানান, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল তার কাছে চাঁদা দাবি করেছিল। তিনি তা দিতে অস্বীকৃতি জানালে, প্রতিহিংসামূলকভাবে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে এই অভিযান পরিচালিত হয়।
তিনি বলেন, “আমার কষ্টের উপার্জনের টাকায় কেনা গরুর মাংস শুধুমাত্র একজনের মৌখিক অভিযোগে ধ্বংস করা হয়েছে। কোনো ল্যাব টেস্ট, কোনো পরীক্ষা হয়নি। এটা কি ন্যায়বিচার?”
তার অনুপস্থিতিতেই অভিযানে ১২০ কেজি মাংস ধ্বংস করা হয় ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়। বাজারের ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম জানান, রহিমের অনুপস্থিতিতে তিনি তার পক্ষে জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হন।
প্রমাণ ছাড়াই শাস্তি: প্রশ্নবিদ্ধ প্রশাসনিক কার্যক্রম
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. সোলাইমান মুঠোফোনে জানান, “আমাদের কাছে মাংস জব্দ করার সুযোগ ছিল না, ল্যাব টেস্টও করা হয়নি। স্থানীয়দের মতামতের ভিত্তিতেই মাংস ধ্বংস করা হয়েছে।”
অভিযানে কুকুরের কামড়ের কোনো আলামত জব্দ করা হয়নি, মাংসে জীবাণু ছিল কিনা তা পরীক্ষার জন্য কোনো ল্যাব টেস্ট বা ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়নি। অথচ শুধুমাত্র কিছু স্থানীয় লোকের অভিযোগের ভিত্তিতে মাংস বিনষ্ট করা হয়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অবস্থান
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বলেন, “আমরা যথাযথ নিয়ম মেনেই অভিযান পরিচালনা করেছি। অভিযানে যার পক্ষে জরিমানা দেওয়া হয়েছে, তিনি দোষ স্বীকার করেছেন।”
কিন্তু বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই অভিযান প্রতিহিংসামূলক ও অবিচারমূলক ছিল।
প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীর ইন্ধন ও প্রতিশোধের অভিযোগ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ী সবুজ কসাইয়ের ইন্ধনে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছে। অভিযানের পর সবুজ কসাইকে বলতে শোনা যায়, “কেমন দেখাইলাম!”—যা প্রতিহিংসার ইঙ্গিত বহন করে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উদাসীনতা ও বাজারে নৈরাজ্য
স্থানীয়দের অভিযোগ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হাজারো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলেও তারা শুধুমাত্র ফোন পেয়ে অভিযানে যায়, কিন্তু বাজারে নিয়মিত মনিটরিং করে না।
নিম্নোক্ত বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যকর ভূমিকা নেই বলে অভিযোগ রয়েছে:
- ওষুধের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণ
- ভেজাল মসলা ও খাদ্যপণ্য শনাক্তকরণ
- পলিথিন ও কেমিক্যালযুক্ত ফল বিক্রির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া
- অতিরিক্ত দাম নেওয়া দোকানগুলোর মনিটরিং
- মিষ্টির দোকান ও রেস্টুরেন্টে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিরুদ্ধে অভিযান
- ফলের সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা ও তরমুজ কেজিতে বিক্রি বন্ধ করা
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া: ন্যায়ের দাবি
বাজারের ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা বলেন, “আমরা আইনকে সম্মান করি, কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উচিত সঠিক প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া। একজন গরিব ব্যবসায়ীকে এভাবে সর্বস্বান্ত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
একজন ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ভোক্তা অধিকারের কাজ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির ফোন পেয়ে অভিযান পরিচালনা করা নয়, বরং বাজারের প্রতিটি খাত নিয়মিত মনিটরিং করা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণে তারা কেন নিষ্ক্রিয়?”
প্রশাসনের প্রতি আহ্বান
বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনগণ এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরও কার্যকর ও দায়িত্বশীলভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
তারা চান, ভেজালবিরোধী অভিযান হোক নিয়মিত, স্বচ্ছ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তিতে—যাতে ভুল তথ্য দিয়ে নিরপরাধ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
এ ঘটনায় মাংস ব্যবসায়ী রহিমের ক্ষতি যে কয়েক বছরের মধ্যে পূরণ হবে না, তা সকলেই একমত। প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত তার জীবন-জীবিকা ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।