সংগ্রামের পথ বেয়ে সফলতার শিখরে সৈয়দ মুহাম্মদ রুবেল
জীবনের কঠিন বাস্তবতা অনেককে থামিয়ে দেয়, আবার কেউ কেউ সেই বাস্তবতাকে জয় করে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান। সৈয়দ মুহাম্মদ রুবেল তেমনই একজন মানুষ, যিনি একসময় দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, আর আজ তিনি হাজারো মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা।
সংগ্রামের শুরু: নদীভাঙনের ছায়ায় বেড়ে ওঠা
জন্মের পর থেকেই একের পর এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। যমুনা নদী ছয়বার তার বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে গেছে, পরিবারের দশ ভাই-বোনের মাঝে টিকে থাকার লড়াই ছিল প্রতিনিয়ত। জমিজমা হারিয়ে যখন সবকিছু অনিশ্চিত, তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেন—সফল হতেই হবে!
শুরু হয় তার নিরলস অধ্যবসায়ের যাত্রা। কখনো রুমের বারান্দায়, কখনো মোবাইলের আলোয়, কখনো কাজের ফাঁকে, আবার কখনো চাঁদনী রাতে—এভাবেই তিনি চালিয়ে যান পড়াশোনা।
শিক্ষা ও কর্মজীবন: চাকরির মোহ থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন
তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ও এমপিএইচ ডিগ্রি অর্জন করেন। ক্যারিয়ারের শুরুতে আইসিডিডিআরবি-তে প্রজেক্টের কাজে যুক্ত হন, এরপর প্রাইম ব্যাংকে চাকরি করেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল চাকরির পরিবর্তে কর্মসংস্থান তৈরি করা।
তিনি ব্যবসা শুরু করলেও প্রথমে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েন। উপায় না দেখে আবারও চাকরিতে ফিরে যান। দুই বছর কাজ করার পর পুনরায় ব্যবসার পথে নামেন। শুরুতে আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে উপহাস ও অবহেলা পেলেও ধীরে ধীরে তার উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখতে শুরু করে।
প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা: ছয়টি কোম্পানি ও হাজারো কর্মসংস্থান
করোনা মহামারির ভয়াবহ সময়ে যখন অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে একে একে তিনটি নতুন প্রতিষ্ঠান চালু করেন। বর্তমানে তার ছয়টি কোম্পানি রয়েছে, যেখানে কর্মসংস্থান পেয়েছে অসংখ্য মানুষ, বিশেষ করে গ্রাম ও চরাঞ্চলের মেধাবী তরুণরা, যারা আর্থিক কারণে উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে পারছিল না।
মানবসেবার অঙ্গীকার: ফিরোজা-বাছেদ মাষ্টার ফাউন্ডেশন
নিজের সফলতার পাশাপাশি তিনি সবসময় মানুষের কল্যাণে কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “ফিরোজা-বাছেদ মাষ্টার ফাউন্ডেশন”, যার মাধ্যমে দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদান করা হয়। বিশেষ করে, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে ভর্তি হলেও আর্থিক সংকটে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না, তাদের পাশে দাঁড়ায় এই ফাউন্ডেশন।
এছাড়াও, কুরআন, হাদিস বিতরণ, মসজিদের খাটিয়া, ওজুখানা নির্মাণ, কাফনের কাপড় বিতরণ, লাশ পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করাসহ নানা সামাজিক ও ধর্মীয় সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে।
ভ্রমণপ্রিয়তা ও লেখালেখির নেশা
বিশ্ব দেখার ইচ্ছা থেকেই তিনি এখন পর্যন্ত ৩৩টি দেশ এবং বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা ভ্রমণ করেছেন। ভবিষ্যতে আরও অনেক দেশ ঘুরে দেখার ইচ্ছে রয়েছে তার।
লেখালেখির প্রতিও তার তীব্র আগ্রহ রয়েছে। তিনি এখন পর্যন্ত ৬টি উপন্যাস, ৩টি ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ ও ১২টির বেশি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। তার অন্যতম আগ্রহের বিষয় হলো হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও ইতিহাস অনুসন্ধান।

মানুষের জন্য কাজ করার ব্রত
সৈয়দ মুহাম্মদ রুবেলের বিশ্বাস, “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য”—এই মূলমন্ত্র হৃদয়ে ধারণ করেই তিনি চলতে চান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চান, যাতে তার মতো কেউ কখনো হেরে না যায়, কেউ দারিদ্র্যের কাছে মাথা নত না করে।
তিনি আজ যে অবস্থানে পৌঁছেছেন, তা সহজ ছিল না। কিন্তু কঠিন পরিশ্রম, অধ্যবসায়, এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করার ইচ্ছাই তাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। তার জীবন আমাদের শেখায়—সত্যিকার ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো প্রতিকূলতাকে জয় করা সম্ভব।