
শম্ভুগঞ্জ ইউ.সি. উচ্চ বিদ্যালয়ে দুর্নীতি: শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতা ও অপব্যবহার নিয়ে ঝড় উঠেছে
ময়মনসিংহ জেলার ঐতিহ্যবাহী শম্ভুগঞ্জ ইউ.সি. উচ্চ বিদ্যালয়ে সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে তোলপাড় চলছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির স্বেচ্ছাচারিতা এবং অপব্যবহারের কারণে একের পর এক অভিযোগ ওঠায় এলাকার অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যালয়ের একটি গৌরবময় ইতিহাসের দিকে চোখ রেখেই এখন প্রশ্ন উঠেছে— কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম?
কোচিং সেন্টারের টাকা আদায়ের অভিযোগ
বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক আজিম উদ্দিনের বাড়ির দ্বিতীয় তলায় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য একটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এই কোচিং সেন্টারে ছাত্রদের বাধ্য করা হচ্ছে এবং প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৬,০০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। মোট ১২ লক্ষ টাকার অপব্যবহার হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন অভিভাবকরা। অভিভাবকদের মতে, তাদের সন্তানদের এই কোচিংয়ে অংশগ্রহণে কোনো ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা আরোপ করা হচ্ছে।
তহবিল ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অনিয়ম
বিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যালয়ের পুকুর ভাড়া বাবদ ৩ লক্ষ টাকা আদায় করা হলেও তা কোনো তহবিলে জমা হয়নি।
লিজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পুনরায় যুবলীগ কর্মী মনিরকেই গোপনে টাকা নিয়ে আবারও পুকুরে মাছ চাষ করার অনুমতি দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে একইভাবে, অকেজো মালামাল বিক্রি করে ১ লক্ষ ৩ হাজার টাকা আয় হলেও সেগুলি বিদ্যালয়ের কোনও উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা হয়নি। এমনকি ক্যান্টিন ভাড়া বাবদ ৪০ হাজার টাকা গ্রহণ করা হলেও তার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। এ সমস্ত অনিয়মের কারণে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আর্থিক পরিস্থিতি মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
গাইড বই বিক্রির নামে বাণিজ্য
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট একটি গাইড বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, পাঞ্জেরী গাইড কোম্পানির বই কেনার জন্য ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করা হয়েছে, এবং অন্য কোনো গাইড বই ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের আয় বৃদ্ধির একটি কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পুরাতন ভবন বিক্রির দুর্নীতি
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের নামে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ভবন ভাঙার মালামাল বিক্রি করা হয়েছে, তবে সেই অর্থ বিদ্যালয়ের তহবিলে জমা হয়নি। এছাড়া, ভবন ভাঙার কাজের জন্য কোনো উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি এবং নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর ফলে এলাকার জনগণের মধ্যে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
সাবেক সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ
এসব দুর্নীতির অভিযোগের পর, বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন শিক্ষকের বিরুদ্ধেও স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনৈতিক আচরণের অভিযোগ রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
পদত্যাগের ঝড়: ৬ সদস্যের পদত্যাগ
এই দুর্নীতির ঘটনায় বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির ৬ জন সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেছেন। তাদের দাবি, বিদ্যালয়ের সভাপতির স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং বিদ্যালয়ের দুর্নীতির বিষয়ে প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
প্রতিবাদ এবং প্রশাসনের ভূমিকা
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন এবং বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন এবং শিক্ষা বোর্ড ইতিমধ্যেই বিষয়টির তদন্ত শুরু করেছে। তবে স্থানীয় জনগণের দাবি, শুধু তদন্ত নয়, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা উচিত।
শম্ভুগঞ্জ ইউ.সি. উচ্চ বিদ্যালয় একসময় ছিল ময়মনসিংহ জেলার শিক্ষার একটি আলোকবর্তিকা। তবে বর্তমান দুর্নীতির আড়ালে বিদ্যালয়ের সেই গৌরবময় ইতিহাস ম্লান হতে চলেছে। প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
প্রতিবেদন প্রস্তুতকারক: মোঃ বিল্লাল হোসেন মানিক, ময়মনসিংহ।